Tuesday, September 10, 2019

প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা


প্রশ্নঃ প্লেটো তার রিপাবলিক গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রের যে রূপরেখা অঙ্কন করেছেন তা সমালোচনা সহকারে আলোচনা করো। 

 উত্তরঃ
ভূমিকাঃ পৃথিবীর ইতিহাসে গ্রিক নগররাষ্ট্রসমূহের অভ্যুদয় বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত । গ্রিসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্র এক সময় যুদ্ধে লিপ্ত ছিল । সে সময় কোনাে রাজ্যেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল না । তৎকালীন গ্রিনের সামাজিক ও রাজনৈতিক অরাজকতার প্রেক্ষিতে The Republic ' গ্রন্থে প্লেটো একটি সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা করেছেন । তার মতে , সুন্দর জীবনের জন্য প্রয়ােজন সুন্দর পরিবেশ এবং তা পাওয়ার জন্য দরকার পূর্ণাঙ্গ একটি সমাজব্যবস্থা । গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার The Republic ' গ্রন্থে এই অবস্থার প্রেক্ষাপটেই একটি ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেছেন । বস্তুত , প্লেটোর রাজনৈতিক চিন্তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের উৎপত্তি:  প্লেটো ঘটনা , সময় , অবস্থা ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আদর্শ রাষ্ট্রের উৎপত্তির । কথা বলেছেন । প্লেটোর সময়ে গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলাে পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত ছিল । প্রকৃতপক্ষে কোনাে রাজ্যেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল না । গ্রিসের এ ব্রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দূর করার লক্ষ্যে প্লেটো তার বিখ্যাত গ্রন্থ ' The Republic ' এ একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামাে বর্ণনা করেন । প্লেটো গ্রিসের তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে একটি সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন । এ প্রচেষ্টার ফলাফলস্বরূপ প্রকাশিত হয় । বিখ্যাত গ্রন্থ ' দি রিপাবলিক ' । প্লেটো তার । The Republic " গ্রন্থে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাপ্রসূত একটি রাষ্ট্রের পরিকল্পনা দিয়েছেন । তার ভাষায় এটি হলাে আদর্শ রাষ্ট্র । গেটোর মতে , আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবে সত্য নয় । বাস্তব সব সময় পরিবর্তনশীল বিধায় অস্থায়ী ও অসামঞ্জস্যহীন হয়ে থাকে । কোনাে বান্তর রাষ্ট্রই প্রকৃত রাষ্ট্রের দাবি করতে পারে না । কারণ তারা সার্বক্ষণিক সামাজিক , অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে পরিবর্তিত হতে থাকে । প্রকৃতপক্ষে তিনি ন্যায় ও সুন্দর জীবনের বিকাশ ঘটাতেই আদর্শ রাষ্ট্রের উৎপত্তির কথা বলেছেন ।

 প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র  : প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার ধারণাটি যে দুটি ভিত্তির উপর দণ্ডায়মন তার একটি হলাে সুদর্শ রাষ্ট্র । এবং অন্যটি হলাে ন্যায়বিচার তত্ব । কিন্তু ন্যায়বিচার তত্ত্বটিকে আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা থেকে পৃথক করা যাবে না এ কারণে যে , এটি আদর্শ রাষ্ট্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য । প্লেটো তার ' The Republic ' গ্রন্থের মধ্যে যে আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা করেছেন তা নির্দিষ্ট কোনাে রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক বর্ণনা নয় । প্লেটো যে আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা দিয়েছেন তা বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভব কি - না সে সম্পর্কে তিনি বিশেষ মাথা ঘামান নি । তার মুখ্য উদ্দেশ্য হলাে , রাষ্ট্রের যথার্থ স্বরূপ বিশ্লেষণ করা । অধ্যাপক সেবাইন তার । ' AIListory of Political Theory ' গ্রন্থে বলেন , তিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যা কখনাে আদশ উগ্ধ । কিংবা আদর্শ বহির্ভূত প্রক্রিয়ায় কার্য সম্পাদনে সচেষ্ট ছিল । "

 প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের নীতিমালা: মহাজ্ঞানী প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রে উত্তম জীবন কামনা করেছেন । উত্তম জীবন । প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনায় কতিপয় নীতির কথা বলেছেন । নিম্নে এগুলাে আলােচনা করা হলাে :
( ১ ) অনৈশ্বর্য নীতিঃ আদর্শ রাষ্ট্রের প্রথম নীতি ঐশ্বর্য উপেক্ষা করা । প্লেটোর মতে , আদর্শ রাষ্ট্রে কোনাে প্রকার প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য থাকবে না । প্রাচুর্য বা ঐশ্বর্য থাকলে মান্য কর্মে অনীহা প্রকাশ করবে । তার মতে , ঐশ্বর্যবিহীন রাষ্ট্র উত্তম রাষ্ট্র ।
( ২ ) কর্মপরিধি নীতি: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে কর্মপরিধির নীতি অনুসৃত । তিনি প্রত্যেক ব্যক্তির স্ব - স্ব কর্মপরিধির ১ কথা বলেছেন । আর দার্শনিক রাজাই প্রত্যেকের কর্মপরিধি নির্ধারণ করবেন । প্রত্যেক ব্যক্তি যাতে নিজ নিজ কর্ম সম্পাদন করেন শাসকগণ তার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন ।
( ৩ ) আয়তন বিধি : প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রে সুনির্দিষ্ট আয়তন বিধির কথা বলেছেন । তিনি কর্মপরিধির সাথে সাথে রাষ্ট্রের আয়তন বিধির কথাও বলেন । তার মতে , রাষ্ট্রের আয়তন খুব বেশি হবে না । কেননা রাষ্ট্রের আয়তন বেশি হলে বিভিন্ন । সমস্যা দেখা দেয় । তাই রাষ্ট্রের আয়তন হতে হবে মধ্যম প্রকৃতি ।
( ৪ ) শিক্ষানীতি : প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে একটি শিক্ষানীতি বিদ্যমান ছিল । তিনি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনকল্পে শিক্ষানীতির উপর অধিক গুরুত্ব আরােপ করেছেন । তিনি বলেন , অনুসৃত শিক্ষানীতি হবে মানব চরিত্র গঠনের একমাত্র উপায় ।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের রুপরেখা / কাঠামোঃ
 নিম্নেপ্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা / কাঠামাে সম্পর্কে আলােচনা করা হলােঃ
 ( ১ ) রাষ্ট্রের উদ্ভব : প্লেটো রাষ্ট্রের উদ্ভব প্রসঙ্গে বলেন , রাষ্ট্র পাশবিক শক্তির ফলশ্রুতি নয় । মানুষের প্রয়ােজনের তাগিদেই রাষ্ট্র গঠিত হয় । মানুষের জীবনের নানাবিধ সমস্যা এবং আশা - আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য পরস্পরের সাহায্য সহযােগিতার প্রয়ােজন হয় এবং এ প্রয়ােজনের তাগিদেই সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের । এ প্রসঙ্গে প্লেটো বলেন , " রাষ্ট্র কোনাে এক বৃক্ষ বা শিলা থেকে উৎপন্ন হয় নি , মানুষের মনেই এর উৎপত্তি এবং মানুষের মনেই এর বাস । " |
( ২ ) মানুষের শ্রেণীবিন্যাস : রাষ্ট - যেহেতু মানব মনেরই ফলস্বরূপ , সেহেতু প্রেটো মানুষ ও রাষ্ট্রের প্রকৃতিতে সাদৃশ্য দেখতে পান । তিনি মানবাত্মার তিনটি প্রবণতা লক্ষ করেন । যথাঃ ( ক ) প্রজা বা যুক্তিবােধ ; ( খ ) সাহস বা শৌর্য - বীর্য এবং ( গ ) ভােগস্পৃহা । মানব মনের তিন প্রকার প্রবণতাকে ভিত্তি করে প্লেটোর আদর্শ ব্রাষ্ট্রে তিনটি শ্রেণীর উদ্ভব হয় । নিম্নে এ তিনটি শ্রেণী সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে।
( ক ) অভিভাবক বা শাসক শ্রেণী: সমাজের কল্যাণার্থে ও আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তিরূপে অধিষ্ঠিত থাকবে যুক্তিবাদী । আত্মার ধারক অভিভাবক বা শাসক শ্রেণী । তারা দার্শনিক রাজার সাহায্যার্থে নিয়ােজিত থাকবে । তারা আদর্শ রাষ্ট্রের অভিভাবক । এ অভিভাবক শ্রেণী পরিণত বয়সের জ্ঞানবান ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হবে । অভিভাবকগণ জ্ঞানচর্চা করবে । প্লেটো মনে করতেন , যাদের উপর জনসাধারণের মঙ্গলের ভার ন্যস্ত থাকে তাদের যদি পরিবার ও সম্পত্তি থাকে তবে তাঁরা নির্লোভ ও নিরপেক্ষভাবে শাসনকার্য চালাতে পারবে না । তাই প্লেটো তাদের পরিবার ও সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন ।
( খ ) যােদ্ধাশ্রেণী: বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করা এবং আইন - শৃঙ্খলার স্বার্থে একদল সুশিক্ষিত ও দায়িত্বশীল সৈনিকের প্রয়ােজন । তাই এ শ্রেণীর লােকেরা রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত থাকবে । উক্ত দায়িত্বসমূহ যথাযথ পালনে তারা শিকারি কুকুরের ন্যায় মিত্রের প্রতি মিত্রসুলভ এবং শক্রর প্রতি শক্রসুলভ আচরণ করবে । যুদ্ধকাৰ্য ব্যতীত তাদের অন্য কোনাে কাজ থাকবে না । বাল্যকাল থেকেই তাদের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে হবে । কোনাে ব্যক্তিকে সেনাবাহিনীতে নিয়ােগের পূর্বে তার যােগ্যতা , মানসিক প্রবণতা ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেখতে হবে । এ শ্রেণী রাষ্ট্রশাসনে অভিভাবকদের সহায়তা করবে এবং সাম্যবাদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে ।
( গ ) উৎপাদক শ্রেণী: মানবাত্মার সর্বনিম্ন অংশের বৈশিষ্ট্য যেমন ক্ষুধা তদ্রপ রাষ্ট্র - দেহের সর্বনিম্ন স্তরে প্রবৃত্তির ধারক উৎপাদক শ্রেণীর অবস্থান । তারা প্রয়ােজনীয় খাদ্য , বস্ত্র ও দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন ও সরবরাহ করে মানবের নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়ােজন মেটানাের দায়িত্ব গ্রহণ করবে । এ শ্রেণী সকল প্রকার রাজনৈতিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হবে । এক্ষেত্রে প্লেটোর সতর্কবাণী হলাে , পরিজনের সংখ্যা খাদ্যের পরিমাণকে অতিক্রম করবে না । সুস্বাদু এবং শক্তিশালী খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে দীর্ঘ জীবন লাভ করবে এবং পরিণত বয়সে সন্তানদের জন্য অনুরূপ জীবনের উত্তরাধিকারী করে রেখে যেতে হবে ।
( ৩ ) ন্যায়নীতি: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র তার ন্যায় ধর্মের ধারণা থেকে গৃহীত হয়েছে । ন্যায় ধর্মের সাথে তার আদর্শ । রাষ্ট্রের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান । যে ব্যক্তি যে কাজের জন্য সর্বাপেক্ষা যােগ্য ও সর্বোত্তম তাকে সেই কাজের দায়িত্ব অর্পণ করাই ন্যায়নীতি । এ ন্যায়নীতির উপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রের শ্রমবিভাজন সম্পন্ন হয় , যা বিশ শতকের অর্থনৈতিক তত্ত্বে বিশেষ শুরুত্ব লাভ করে । প্লেটো ন্যায়নীতির ব্যাখ্যায় বলেন , “ সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি যদি অন্যের কাছে হস্তক্ষেপ না করে তবে একদিকে কাজ যেমন সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হবে , অন্যদিকে তেমনি সমাজ থেকে বিশৃখলা দূরীভূত হয়ে সমাজে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হবে । ” তাই ন্যায়নীতি প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের মূলভিত্তি ।
( ৪ ) শিক্ষানীতি:  প্লেটোর দর্শনের মূলমন্ত্র হলাে ' Knowledge is virtue ' আর শিক্ষাই পুণ্য অর্জনের একমাত্র মাধ্যম । প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য শিক্ষার উপর অত্যধিক গুরুত্বারােপ করেছেন । তিনি তার The Republic ' গ্রন্থে শিক্ষানীতির উপর এত গুরুত্বারােপ করেছেন যে , শিক্ষা সম্বন্ধে অন্য কোনাে দার্শনিক তা করেন নি । তিনি বুষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেন । শিক্ষাকেই প্লেটো শ্রমবিভাগের ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করেছেন । শিক্ষার মাধ্যমে যােগ্যতা যাচাই করে তিনি অভিভাবক ও যােদ্ধা শ্রেণীর লােক নির্বাচনের পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন । প্লেটোর শিক্ষা পদ্ধতি সম্বন্ধে অধ্যাপক আনেন্ট বার্কার বলেছেন , “ এটি মানসিক ওষুধের মাধ্যমে মানসিক ব্যাধি দূরীকরণের একটি প্রচেষ্টা । অধ্যাপক সেবাইনের মতে , “ রাজনীতিবিদদের পথ - নির্দেশ করার জন্য সাম্যবাদু অপেক্ষা শিক্ষার উপরই প্লেটো অধিক আহা স্থাপন করেন । ”

( ৫ ) দার্শনিক রাজা: প্লেটোর মতে , যারা অত্যধিক জ্ঞানী , বিবেক - বুদ্ধিসম্পন্ন এবং শাসন করার ক্ষমতার অধিকারী তারা হচ্ছেন দার্শনিক রাজা । এ দার্শনিক রাজাই হবেন আদর্শ রাষ্ট্রের কর্ণধার । দার্শনিক রাজার শাসনকার্যে প্লেটো এত নিশ্চিত ছিলেন যে , তিনি তাকে আইন দ্বারা সীমিত করেন নি । বস্তুত দার্শনিক রাজা জ্ঞানের সাধক , সত্যের দিশারি , ন্যায়ের অবতার । লােভ - লালসা তাদের চরিত্রকে কখনাে কলুষিত করে না , ভয় - ভীতি তাদের কর্তব্য কার্য থেকে বিচ্যুত করে না । তাদের চরম ও পরম কামনা রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজেদের সর্বতােভাবে উৎসর্গ করা । তিনি বলেন , “ পুরাে জনগােষ্ঠী দার্শনিক হতে । পারবে না । " প্লেটো বিশ্বাস করতেন যে , দার্শনিক রাজা ছাড়া রাষ্ট্রের উন্নতির কোনাে সম্ভাবনা নেই ।

( ৬ ) সাম্যবাদ: প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবায়ন ও ন্যায়ধর্ম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অপরিহার্য শর্ত হিসেবে অভিভাবত শ্রেণীর জন্য এক অভিনব সামাহা প্রবর্তন করতে চেয়েছেন । তিনি অভিভাবক শ্রেণী অর্থাৎ শাসক ও যােদ্ধা শ্রেণীর জন্য এমন নতুন সাম্যবাদী ব্যবহার প্রবর্তন করতে সক্ষম হন যাতে তারা পরিবার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন । সুদঢ় রাষ্ট্রীয় ঐক্য গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে শসিকবর্গের সকল ব্যক্তিগত লােভ - লালসা দূর করাই প্লেটোর সাম্যবাদের একমাত্র লক্ষ্য ।

সমালােচনা: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রতত্ত্বটি বিভিন্নভাবে সমালােচিত হয়েছে । প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সমালােচনাসমূহ নিম্নে প্রদত্ত হলাে:

 ( ১ ) ব্যক্তিসত্তা বিসর্জন: আদর্শ রাষ্ট্রে প্লেটো রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে অধিক উপমা স্থাপন করেন । তিনি রাষ্ট্র ও ব্যক্তিকে একীভূত করে ফেলেছেন । বস্তুত রাষ্ট্র ও ব্যক্তি পৃথক জিনিস । তিনি ব্যক্তিসত্তাকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বেদিমূলে বিসর্জন নিয়েছেন ।
( ২ ) রাজনীতির সাথে নীতিশাস্ত্রের পার্থক্য: প্লেটো তার কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রে রাজনীতির সাথে নীতিশাস্ত্রের পার্থক্য নির্ণয় হ্রতে সক্ষম হন নি ।
( ৩ ) উৎপাদক শ্রেণীকে অবহেলা:  রাষ্ট্রের বৃহৎ শ্রেণী অর্থাৎ উৎপাদক শ্রেণীকে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে চরম অবহেলারা হয়েছে । তাদের সামাজিক মর্যাদা না দিয়ে শুধু ভােগ্যবস্তুর উৎপাদনকারী হিসেবে গণ্য করা হয় ।
( ৪ ) মানব প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ : প্লেটো তার আদর্শ সমাজব্যবস্থায় অভিভাবক শ্রেণীর জন্য পরিকল্পিত সাম্যবাদের দ্বারা মানব প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করেছেন ।
( ৫ ) ব্যক্তিত্ব খর্ব : প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের মূলনীতি " বাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি , ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয় । প্লেটোর নাততে মানুষকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযােগ থেকে বঞ্চিত করার ফলে ব্যক্তিত্ব খর্ব হয়ে যায় ।
 ( ৬ ) দার্শনিক রাজার অতিরিক্ত প্রশংসা : তিনি দার্শনিক রাজার বিচা - বছিৱ অতিরিক্ত প্রশংসা করেছেন । | তাদের তিনি ধার্মিক , সৎ ও ন্যায়পরায়ণ বলেছেন , কিন্তু তাদের চরিত্রের কথা মােটেই উল্লেখ করেন নি ।
( ৭ ) দার্শনিক রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতা : প্লেটো দার্শনিক রাজার উপর চরম ক্ষমতা আরােপ করে তাকে আইনের উর্বে স্থান দিয়েছেন । দার্শনিক রাজাদের এরূপ স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা তাদের নিজেদের মর্যাদাহানি করে তুলেছে ।

 (৮) অবাস্তব কল্পনা: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র একটি অবাস্তব কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয় । তিনি নিজেই বলেন , যে দার্শনিক রাজার উপর রাষ্ট্রের শাসনভার ন্যস্ত হবে তাদের সন্ধান একমাত্র স্বর্গরাজ্যেই মিলবে ।
( ৯ ) সংবিধানের অনুপস্থিতি : প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে কোনাে সংবিধানের ব্যবস্থা নেই । অর্থাৎ এতে সংবিধানের অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায় ।
( ১০ ) রাষ্ট্রতত্ত্ব বিনষ্ট : রাষ্ট্রে মাত্রাতিরিক্ত ঐক্য স্থাপন করতে গিয়ে তিনি রাষ্ট্রতত্ত্বকে বিনষ্ট করেছেন । উপসংহারঃ উপরিউক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে , প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র মতবাদ কিছুটা কল্পনাপ্রসূত বা অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হলেও দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে , তার আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা অন্যায় , অবিচার ও কুশাসনের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিবাদ হিসেবে আলােড়ন সৃষ্টি করেছে । তার রাষ্ট্র সম্পর্কিত মতবাদ বর্তমানকালের রাষ্ট্রচিন্তায় গভীরভাবে প্রভাব । বিস্তার করে আছে । তার আদর্শ রাষ্ট্রের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর প্রায় অনেক দেশেই অনুসরণ করা হয় । আজো আমরা । বিবেকবান ও নিঃস্বার্থ শাসকের সন্ধান করি যিনি অন্যের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ । সুতরাং প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র অত্যন্ত যৌক্তিক । ও কার্যকর একটি রাষ্ট্রচিন্তা মতবাদ।

3 comments: