Wednesday, September 4, 2019

কাশ্মীর সমস্যা


কাশ্মীর: ভূ-স্বর্গ থেকে নরকে পরিণত হবার করুণ ইতিহাস 
লেখাঃ রিয়াদ বিন ইসলাম

কাশ্মীর নামটি শুনলেই ভেসে উঠে লাশের মিছিল নিয়ে আর্তনাদ করা ভয়ানক এক নগরীর। প্রতিটি সেকেন্ড কাটাতে হয় সীমা হীন অনিরাপত্তার চাদরে। কিন্তু আবার এই কাশ্মীরকেই বলা হয় ভূ-স্বর্গ! কেন কাশ্মীরের এই করুন পরিণতি? কারা দায়ী? কেনই বা সৃষ্টি হয় সংঘাতের? ব্রিটিশ শাসিত ভারত উপমহাদেশের যে কয়টি স্থান নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল কাশ্মীর তাদের মধ্যে অন্যতম। কাশ্মীরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকসমস্যা ও সমাধান নিয়ে বিস্তারিতআলোচনাঃ
ভৌগলিক  অবস্থা ও জলবায়ুঃ 
কাশ্মীরের অবস্থান মধ্য হিমালয়ে।কাশ্মীরের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার। বানিহাল থেকে বারামুলা। আর প্রস্থে ৪২ কিলোমিটার।বৃষ্টির পরিমাণ খুবই কম, তবে বৃষ্টির একদম দেখা মিলে না এই রকম না। মার্চ-এপ্রিল মাসে পশ্চিমের ভূ-মধ্যসাগরে থেকে বয়ে আসা শীতল ওপুবালী বাতাসে বৃষ্টি হয়। চারপাশেরপর্বত সারির মধ্যে সমতল ভূমিতেমানুষের বসবাস।  কাশ্মীরের পশ্চিমদিকে পর্বতের বেষ্টনী উন্মুক্ত হয়ে চলেগেছে নদী আর সড়ক। ওয়াল্টারআর. লরেঞ্জ’র বর্ণনায় কাশ্মীরহলো, “ কালো পর্বতমালার মধ্যেএক খন্ড জমিন সাদা পায়ের ছাপেরমতো”।বর্তমান ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীররাজ্য (যেটি জম্মু, কাশ্মীর উপত্যকা ও লাদাখেরসমন্বয়ে গঠিত), পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরও গিলগিত-বালতিস্তান অঞ্চলদ্বয় এবং চীন-নিয়ন্ত্রিতআকসাই চিন ও ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্ট অঞ্চলদ্বয় বৃহত্তর কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত। ।
সভ্যতার বিকাশ ও ধর্মীয় সম্প্রীতি :
হিন্দু মিথোলজি অনুসারে ‘কাশ্বাপ’নামে এক সাধু তীর্থযাত্রা কালে জানতেপারেন স্বতিস্বর নামে এক জলাশয়েরকথা। স্বতিসর ভূতের দখলে ছিল বলেপ্রচলিত ছিল। সাধুর ইচ্ছায় দেবীসারিকা পক্ষীর আকারে সেখানেউপস্থিত হন এবং স্বর্গীয় পাথরেরসাহায্যে ভূতদের বিতাড়িত করেন। পরবর্তীতে ঐ পাথর থেকে সৃষ্টি হয়পর্বতমালার, যেটা বর্তমানে কাশ্মীরনামে পরিচিত। সাধুর নামেই বর্তমানকাশ্মীরের নাম করন করা হয়েছে বলেধারনা করা হয়।
বৈজ্ঞানিক ধারণা মতে রাশিয়ান প্লেট ওইন্ডিয়ান প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষের ফলেএই উপত্যকা সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে,  এখানে মানববসতি স্থাপন হয়েছে ৩০০০ বছরআগে। কাশ্মীরের আদি বাসিন্দাদেরমূলত তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করাহয়েছে- নাগ, পিশাচ ও ইয়াক্ষা । এসবগোষ্ঠী লেক বা নালার পাশে বাসকরত। তাদের বন্য পশু ও সাপের সাথেলড়াই করতে হত বলে তাদেরকে এসবনামে ডাকা হত বলে মনে করা হয়।
স্থানীয় ভাষায় কাশ্মীরকে বলা হয়‘কাশীর’ নামে। যার অর্থ দাড়ায় যেখানে‘কশুর’ লোকেরা বাস করে। মাংসভক্ষন করত বলে তাদের কশুর বলেঅভিহিত করা হত। শীতল ও নিরিবিলিহওয়ায় কাশ্মীর যুগে যুগে সাধু ও কবিসাহিত্যিকদের তীর্থ স্থানে পরিণতহয়েছে।
প্রথম এক শতক ব্রাহ্মণ বাদ ও বৌদ্ধশাসনের আসা যাওয়ার মধ্য দিয়েঅতিবাহিত হয়েছে। কাশ্মীরে বৌদ্ধ ধর্মক্রমান্বয়ে প্রবেশ করে বানারাসের একদূতের মাধ্যমে। তার নাম ছিলমাঝান্তিকা। তিনি ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটান। এ সময়সম্রাট অশোক ছিল ক্ষমতায়। তিনিমাঝান্তিকাকে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারেসহায়তা করেন। একই সময়ে শিবইজমও প্রচারিত হতে থাকে। কিন্তু সম্রাটঅশোকের একান্ত ইচ্ছার ফলে বৌদ্ধধর্ম ব্যাপক হারে বিস্তৃতি লাভ করে। তার মৃত্যুর পর বৌদ্ধ ধর্ম গুরুরা ব্রাহ্মণআবাদূতের কাছে ধর্মীয় তর্কে হেরেযায়। ফলে নতুন করে শুরু হয় শিবধর্মের প্রচারনা । ঐ সময় থেকে হিন্দুতথা ব্রাহ্মনবাদ ও বৌদ্ধ ধর্ম গোড়াগেথেঁ যায় কাশ্মীর ভূ-খন্ডে। বর্তমানপরিসংখ্যান অনুযায়ী, কাশ্মীরে ৬৮.৩% মুসলিম, ২৮.৪% হিন্দু, ১.৯% শিখ, ০.৯% বৌদ্ধ, এবং ০.৩% খ্রীষ্ট ধর্মেরঅনুসারী বসবাস করে।
কাশ্মীরে ইসলাম ধর্মের আগমন কোনরাজার দখল বা শোষণের মাধ্যমেআসে নি। বিভিন্ন সূফী ও পীরদেরমাধ্যমে ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করেইসলাম। ইতিহাস অনুযায়ী, ইসলামসরাসরি আরব থেকে কাশ্মীরে এসেছেমধ্য এশিয়ার ভায়া হয়ে। ফলেপরবর্তীতে কাশ্মীর বিভিন্ন মুসলিমশাসকদের অনুকূল ছিল। উল্লেখযোগ্যযে, কাশ্মীরের পর্যটন কেন্দ্রগুলোরসিংহভাগই গড়ে তুলেছিলেন মোগলশাসকরা।
কাশ্মীর বিক্রির করুনইতিহাস :
মোগল শাসকদের পরবর্তীতে আফগানশাসনের অধীনে ছিল কাশ্মীর, যদিওআফগান শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। ১৮১৯ সালে কাশ্মীর দখল করেশিখরা। শিখদের মূল দরবার ছিললাহোরে। শিখ সাম্রাজ্যের রাজা ছিলেনরঞ্জিত সিং। এই সাম্রাজ্যের অধীনেছিল জম্মুর ডোগরা জমিদার গুলাবসিং। কিন্তু ডোগরা জমিদারেরাব্রিটিশদের তোষামোদ করতে ব্যস্তছিল। ঐ সময় ভারতের বিস্তর অংশইছিল ব্রিটিশদের দখলে। ১৮৩৯ সালেরঞ্জিত সিং মারা গেলে দুর্বল হয়ে পড়েশিখ সাম্রাজ্য। ১৮৪৫ সালের ১৩ডিসেম্বর ব্রিটিশ জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জশিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যুদ্ধে গুলাব সিং শিখদের কোন প্রকারসাহায্য করে নি, যদিও সে শিখসাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। প্রথম ব্রিটিশশিখ যুদ্ধে ব্রিটিশরা বিজয়ী হয় এবংএকই সাথে শিখ সাম্রাজ্য ইস্ট ইন্ডিয়াকোম্পানীর অন্তর্গত হয়। ব্রিটিশদেরপ্রতি আনুগত্য প্রকাশের পুরস্কারহিসেবে ১৮৪৬ সালের ১৬ মার্চ, অমৃতসরে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত চুক্তি অনুযায়ী ৭৫ লাখ রুপিরবিনিময়ে গুলাব সিংকে কাশ্মীর সহকয়েকটি পাহাড়ি জেলার মালিকানাদেয়   ব্রিটিশ সরকার। চুক্তি অনুসারেঐ খানকার মানুষগুলো মূলত হয়েছিলকেনা বেচা। গুলাব সিং খুশি হয়েপ্রতিবছর একটা ঘোড়া, ১২ টা ছাগলএবং তিন জোড়া কাশ্মিরী শাল প্রদানকরত ব্রিটিশ সরকারকে।
কাশ্মীরের এই কেনা বেচাকে মহাত্মাগান্ধী ‘ডিড অব সেল’ হিসেবেআখ্যায়িত করেছিলেন। সাংবাদিকআর এস গুল লিখেছেন, “ ডাচদেরকাছে নিউ ইয়র্ক সিটি বিক্রি হয়েছিল১৬১৪ সালে মাত্র ২৪ ডলারে, রাশিয়ারকাছ থেকে মাত্র ৭.২ মিলিয়ন ডলারেআলাস্কা কিনেছিল আমেরিকা। ১৭০বছর পরও ৭৫ লাখ রুপির এই ক্রয়চুক্তি, এখনও কাশ্মীরি জাতি সত্তারসমস্যার মূল হিসেবে সামনে আসছে।” তার পরের এক শতাব্দী চলে ডোগরাজমিদার দের কুশাসন। তারা প্রায়প্রতিটি পণ্য বস্তুর উপর কর আরোপকরেছিল। ডোগরা শাসকরা ব্যয়েরচেয়ে সঞ্চয়ের প্রতি বেশি মনোযোগীছিল। ১৮৬৮ সালে উপত্যকায়রেভেনিউ আদায় হয়েছিল ১৮ লাখ ৩৬হাজার ৩১৮ রুপি!
ইতিহাসঃ
১৯২৫ সালে হরি সিং কাশ্মীরের রাজা হন। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন কাশ্মীরের শাসক। ১৯৪৭ সালে ভারত-বিভাজনের অন্যতম শর্ত ছিল, ভারতের দেশীয় রাজ্যের রাজারা ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবেন, অথবা তাঁরা স্বাধীনতা বজায় রেখে শাসনকাজ চালাতে পারবেন। ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর পাকিস্তান-সমর্থিত পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার বিদ্রোহী নাগরিক এবং পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পশতুন উপজাতিরা কাশ্মীর রাজ্য আক্রমণ করে।
কাশ্মীরের রাজা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলেও গভর্নর-জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে সহায়তা চাইলেন। কাশ্মীরের রাজা ভারতভুক্তির পক্ষে স্বাক্ষর করবেন, এই শর্তে মাউন্টব্যাটেন কাশ্মীরকে সাহায্য করতে রাজি হন। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর হরি সিং কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তিতে সই করেন।২৭ অক্টোবর তা ভারতের গভর্নর-জেনারেল কর্তৃক অনুমোদিত হয়। চুক্তি সই হওয়ার পর, ভারতীয় সেনা কাশ্মীরে প্রবেশ করে অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ভারত বিষয়টি রাষ্ট্রসংঘে উত্থাপন করে। রাষ্ট্রসংঘ ভারত ও পাকিস্তানকে তাদের অধিকৃত এলাকা খালি করে দিয়ে রাষ্ট্রসংঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের প্রস্তাব দেয়। ভারত প্রথমে এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫২ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচিত গণপরিষদ ভারতভুক্তির পক্ষে ভোট দিলে ভারত গণভোটের বিপক্ষে মত দেয়।ভারত ও পাকিস্তানে রাষ্ট্রসংঘের সামরিক পর্যবেক্ষক গোষ্ঠী উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধবিরতি তত্ত্বাবধানে আসে। এই গোষ্ঠীর কাজ ছিল, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখা ও তদন্তের রিপোর্ট প্রত্যেক পক্ষ ও রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিবের কাছে জমা দেওয়া। যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে কাশ্মীর থেকে উভয় পক্ষের সেনা প্রত্যাহার ও গণভোটের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু ভারত গণভোটে অসম্মত হয় এবং এজন্য পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহারে অসম্মত হয়। ভারত গণভোট আয়োজনে অসম্মত হয় এজন্য যে, এটা নিশ্চিত ছিল যে গণভোটে মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরের বেশিরভাগ ভোটারই পাকিস্তানের পক্ষে ভোটদান করবেন ও এতে কাশ্মীরে ভারত ত্যাগের আন্দোলন আরো বেশী জোড়ালো হবে।
মুসলিম প্রধান কাশ্মীর ও অন্যান্য কারণকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হয়। এরপর ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধ হয়।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৯৯-এ অন্ততঃ তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। এছাড়াও,১৯৮৪ সালের পর থেকে সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই দুই দেশ বেশ কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধে জড়িত হয়েছিল। ভারত সমগ্র জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটি তাদের বলে দাবি করে এবং যার মধ্যে ২০১০ সালের হিসাবে, জম্মু বেশিরভাগ অংশ, কাশ্মীর উপত্যকা, লাডাখ এবং সিয়াচেন হিমবাহ নিয়ে প্রায় ৪৩% অঞ্চল শাসন করছে। পাকিস্তান এই দাবির বিরোধিতা করে, যারা প্রায় কাশ্মীরের ৩৭% নিয়ন্ত্রণ করে- এর মধ্যে আছে আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট বাল্টিস্থানের উত্তরাঞ্চল।
কাশ্মীরি বিদ্রোহীরা এবং ভারত সরকারের মধ্যে বিরোধের মূল বিষয়টি হল স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন। কাশ্মীরের গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ১৯৭০-এর শেষভাগ পর্যন্ত ছিল সীমিত এবং ১৯৮৮ সালের মধ্যে ভারত সরকার কত্তৃক প্রদত্ত বহু গণতান্ত্রিক সংস্কার বাতিল হয়ে গিয়েছিল । অহিংস পথে অসন্তোষ জ্ঞাপন করার আর কোনো রাস্তাই খোলা ছিল না তাই ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য বিদ্রোহীদের হিংসাত্মক আন্দোলনের সমর্থন নাটকীয়ভাবে বাড়তে থাকে। ১৯৮৭ সালে বিতর্কিত বিধানসভা নির্বাচন রাজ্যের বিধানসভার কিছু সদস্যদের সশস্ত্র বিদ্রোহীগোষ্ঠী গঠনে অনুঘটকের কাজ করেছিল। ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল, ধর্মঘট এবং আক্রমণের মাধ্যমে শুরু হয় কাশ্মীরের অস্থিরতা।
যদিও জম্মু ও কাশ্মীরের অশান্তির ফলে হাজারো মানুষ মারা গেছে, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেখা গেছে যে সংঘাতে প্রাণহানীর পরিমাণ অনেকটাই কম। প্রতিবাদী আন্দোলন ভারত সরকারের কাছে কাশ্মীরের সমস্যা ও ক্ষোভ জানানোর শক্তি যুগিয়েছে, বিশেষ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে, যারা ১৯৮৯ সালে থেকে ভারত শাসিত কাশ্মীরে সক্রিয় রয়েছে । যদিও বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী ২০০৮ সালের নির্বাচন বয়কটের ডাক দেয় তবুও বহু সংখ্যক ভোটার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার এই নির্বাচনকে সাধারণভাবে নিরপেক্ষ হিসাবে গণ্য করে। এই নির্বাচনে জয়লাভ করে ভারতপন্থী জম্মু ও কাশ্মীর ন্যাশানাল কনফারেন্স রাজ্যে সরকার গঠন করে। ভয়েস অফ আমেরিকা অনুযায়ী, বহু বিশ্লেষকের মতে এই নির্বাচনে উচ্চ সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি - কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের ভারতের শাসনকে সমর্থন করার ইঙ্গিত দেয়। কাশ্মীরের একজন বিশিষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা সাজ্জাদ লোন যদিও দাবি করেন "উচ্চ সংখ্যক ভোটদানের হার"-কে কখনই কাশ্মীরিরা যে আর স্বাধীনতা চান না তার একটি ইঙ্গিত হিসাবে গ্রহণ না করা হয়। ২০০৯ ও ২০১০ সালে আবার অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
বিভাজন সংকট ওদুর্ভাগ্য বরণ :
১৯৪৭ সালে, ব্রিটিশরা যখন বিদায়নেয় তখন তারা ৫৬২ টি প্রিন্সলিস্টেটকে হয় ভারত নয় পাকিস্তানে যোগদিতে বলে। ভারতের স্টেট গুলোভারতে এবং পাকিস্তানের গুলোপাকিস্তানে যোগ দেয়। কিন্তু ৩ টি স্টেটস্বাধীন থাকতে চেয়েছিল। হায়দ্রাবাদ, জুনগর এবং জম্মু ও কাশ্মীর। এদেরমধ্যে হায়দ্রাবাদ এবং জুনগর ছিলহিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ কিন্তু তাদের রাজাছিল মুসলিম। জনগণ বিক্ষোভ করেভারতে যোগদান করার জন্য, ফলেভারতীয় সেনাবাহিনী এ্যাকশনে যায়এবং দখল করে নেয়। পরবর্তীতে গনভোটের মাধ্যমে বৈধতা হাসিল  করেনেয়।
অপরদিকে,  জম্মু এবং কাশ্মীরেরজনসংখ্যা ছিল মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠকিন্তু রাজা ছিল হরি সিং। হরি সিংশুরুতে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেনএবং একই সাথে নেহেরু ও জিন্নাহসাথে দেন দরবারও করছিলেন। হরিসিং কাশ্মীরকে এশিয়ার সুইজারল্যান্ডহিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অংশ করতেজিন্নাহ ছিল বেশ আত্মবিশ্বাসী। তিনিকাশ্মীরকে তার পকেটে রাখা ‘ব্লাঙ্কচেক’ বলে আখ্যায়িত করেন। রাজাহরি সিং এর উপর নেহেরুর আস্থা ছিলকম। নেহেরু, জেলে বন্দি শেখআবদুল্লার মুক্তি চাচ্ছিল। স্বাধীন হবার১৩ দিন পূর্বে রাজা হরি সিংপাকিস্তানের সাথে ‘স্ট্যান্ড স্টিল’ চুক্তিসাইন করে। কিন্তু ভারত এই চুক্তিতেএকমত হয়নি।
দুটি নতুন দেশ জন্ম হবার ফলে বিভিন্নঅঞ্চলে মুসলিম-শিখ-হিন্দু দের মধ্যেদাঙ্গার সৃষ্টি হয়। কাশ্মীরেও একইপরিস্থিতি সৃষ্টি হলে মুসলিমউপজাতিরা পাকিস্তানে পলায়ন করতেথাকে। এই ঘটনায় পাকিস্তান ক্ষুব্ধ হয়েপাহাড়ি নন স্টেট বাহিনীকে কাশ্মীরেরনিয়ন্ত্রণের জন্য প্রেরণ করেন, ২২ শেঅক্টোবর। কারণ চুক্তির কারণেসেনাবাহিনী সরাসরি আক্রমন করতেপারে নাই। বাহিনীর আক্রমনেকাশ্মীরের অধিকাংশ অঞ্চল রাজারনিয়ন্ত্রণেরও বাইরে চলে যায়। তারইপ্রতিক্রিয়ায় মহারাজা হরি সিংভারতের সাহায্য প্রার্থনা করেন। শেখআবদুল্লাহ (কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীনেতা) পরাশর্মক্রমে ভারতের সাথেচুক্তি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তুভারত সরকার তাদের সাথে যুক্ত হবারশর্ত জুড়ে দেয় এবং রাজা হরি সিং তামেনে নেয়। এরই ধারাবাহিকতায়স্বাক্ষরিত হয়  ‘ইন্সট্রুমেন্ট অবএসেশন’।
পাকিস্তান এই চুক্তিকে মেনে নেয় নি, তারা দাবি করে চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে হরিসিংকে বাধ্য করা হয়েছে চুক্তি করতে। চুক্তির পর দিন ভারত তার নিয়মিতসৈন্য বাহিনী প্রেরণ করে এবং ননস্টেট বাহিনীকে হটিয়ে কাশ্মীরের দখলনেয়। একই সময় পাকিস্তানও তাদেরসেনাবাহিনী প্রেরণ করে। ফলে স্বাধীনহবার প্রথম বছরেরই যুদ্ধ বেঁধে যায়দুটি নতুন দেশের মধ্যে। চুক্তি অনুসারেহরি সিং কাশ্মীরে পূর্ণ স্বায়ত্তত্বশাসনচেয়ে নেন এবং শেখ আবদুল্লাহকেঅন্তর্বর্তী কালীন সরকারের প্রধানঘোষণা করেন। এই যুদ্ধের ফলেকাশ্মীর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক অংশ চলে যায় ভারতের নিয়ন্ত্রণে। যার নাম হয় জম্মু এবং কাশ্মীর এবংপাকিস্তানের অংশের নাম হয় আজাদকাশ্মীর।
জাতিসংঘে কাশ্মীর :
১৯৪৮ সালে কাশ্মীর সমস্যা নিয়েবৈশ্বিক সমাধানের জন্য ভারত ওপাকিস্তান উভয় দেশ জাতি সংঘেরসাহায্য প্রার্থনা করে। সমস্যা সমাধানেরজন্য জাতিসংঘ ভারত ও পাকিস্তানসংকট সমাধান বিষয়ক কমিশন গঠনকরে। সমাধান হিসেবে নিরাপত্তাপরিষদের রিজুলেশন ৪৭ প্রস্তাব করাহয় যেখানে ভারত এবং পাকিস্তানকেতাদের নিজ নিজ সৈন্য সরানোরনির্দেশ দেওয়া হয় এবং সর্বশেষ গণভোটের আয়োজন করতে বলা হয়। কিন্তু দিন শেষে ভারত এবং পাকিস্তানকোন পক্ষই তাদের সৈন্য হটিয়ে নেয়নি। কার্যত জাতিসংঘের সমাধান ব্যর্থহয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে অস্ত্র বিরতিচুক্তির মাধ্যমে লড়াই বন্ধ হয় এবং১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি অনুযায়ীভারত এবং পাকিস্তান কাশ্মীরসমস্যাকে নিজেদের মধ্যে সমাধানকরার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং একইসাথে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ অবতারনাকরা হয়।  পরবর্তীতে ১৯৬২ সালেভারত চীন যুদ্ধের ফলে চীন আকসাইচীন অঞ্চল দখল করে নেয়। আবার, পাকিস্তানের বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে(The Trans Karakorum Tract) কাশ্মীরের বিশাল একটি অংশ, সাশগ্রাম ভ্যালি চীনকে উপহার দেয়। ফলে মূল কাশ্মীর ভূখণ্ড তিন ভাগেবিভক্ত হয়ে যায়।
অপরদিকে ১৯৪৮ সালে ভারতীয়সরকার শেখ আবদুল্লাহকে প্রধানমন্ত্রীপদে ঘোষণা করে কাশ্মীরকে পূর্ণ সায়ত্ত্বশাসন দিয়ে দেয়। কাশ্মীরসম্পর্কে ভারতীয় সংবিধানে একটিআর্টিকেল রয়েছে যা   আর্টিকেল৩৭০ নামে বেশ পরিচিত।  এরই মধ্যেদিয়ে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রবাহিতহয়েছে কাশ্মীরের করুণ ইতিহাস। কাশ্মীরের সাধারন   জনগণের উপরচলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নানাবিধঅত্যাচার। কারণ কাশ্মীরের জনগণপরাধীন থাকতে চায় না, তাদের দাবিএকটাই নিজেদের প্রাপ্য অধিকারফিরে পাওয়া। এখনো কাশ্মীরেরপ্রতিটি অলি গলিতে স্লোগান  ওঠে, “ হক হামারা আজাদি, সিনকে লংঙ্গেআজাদি”
===সংবিধানের ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ===
৩৭০ ধারা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর। এই ধারাবলে জম্মুকাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতামুক্ত রাখা হয় (অনুচ্ছেদ ১ ব্যতিরেকে) এবং ওই রাজ্যকে নিজস্ব সংবিধানের খসড়া তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়। এই ধারা বলে ওই রাজ্যে সংসদের ক্ষমতা সীমিত। ভারতভুক্তি সহ কোনও কেন্দ্রীয় আইন বলবৎ রাখার জন্য রাজ্যের মত নিলেই চলে। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে রাজ্য সরকারের একমত হওয়া আবশ্যক। ১৯৪৭ সালে, ব্রিটিশ ভারতকে ভারত ও পাকিস্তানে বিভাজন করে ভারতীয় সাংবিধানিক আইন কার্যকর হওয়ার সময়কাল থেকেই ভারতভুক্তির বিষয়টি কার্যকরী হয়।
ভারতভুক্তির শর্ত হিসেবে জম্মু কাশ্মীরে ভারতীয় সংসদ প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ- এই তিনটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে ক্ষমতাধর।
৩৭০ ধারাকে সাময়িক বলে বিবেচনা করা যেতেই পারে। জম্মু কাশ্মীর বিধানসভা এ ধারা পরিবর্তন করতে পারত, একে বিলোপ করতে পারত বা একে ধারণ করতে পারত। বিধানসভা একে ধারণ করার পক্ষে মত দেয়। আরেকটি ব্যাখ্যা হল- গণভোট না হওয়া পর্যন্ত ভারতভুক্তির সিদ্ধান্ত সাময়িক বলে গণ্য।
রাষ্ট্রপতির আদেশের ভিত্তিতে অনুচ্ছেদ ৩৭০ (৩) বিলোপ করা যেতেই পারে। তবে তেমন নির্দেশের জন্য জম্মু কাশ্মীরের গণপরিষদের সম্মতি প্রয়োজন। কিন্তু গণপরিষদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫৭-তে। ফলে একটা মত হল, ৩৭০ ধারা আর বিলোপ করা যেতে পারে না। তবে এ ব্যাপারে আরেকটি মতও রয়েছে, সেটা হল রাজ্য বিধানসভার সম্মতিক্রমে এই বিলোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
৩৭০ ধারার ১ নং অনুচ্ছেদ উল্লিখিত হয়েছে, যেখানে রাজ্যগুলির তালিকায় জম্মু-কাশ্মীরকে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে ৩৭০ ধারার মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীরে সংবিধান লাগু হবে। তবে ১৯৬৩ সালের ২৭ নভেম্বর নেহরু লোকসভায় বলেছিলেন যে ৩৭০ ধারার ক্ষয় হয়েছে। জম্মু কাশ্মীরে ভারতীয় সংবিধান কার্যকর রাখার জন্য অন্তত ৪৫ বার ৩৭০ ধারা ব্যবহার করা হয়েছে। এ ভাবে রাষ্ট্রপতির আদেশের ভিত্তিতে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রায় নাকচ করা হয়েছে। ১৯৫৪ সালের নির্দেশ মোতাবেক প্রায় গোটা সংবিধানই, সমস্ত সংশোধনী সহ জম্মু-কাশ্মীরে কার্যকর করা হয়েছে। ৯৭টির মধ্যে ৯৪টি যুক্তরাষ্ট্রীয় তালিকা জম্মু কাশ্মীরে লাগু, ৩৯৫ টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ২৬০টি রাজ্যে কার্যকর, ১৩টির মধ্যে ৭টি তফশিলও লাগু রয়েছে সেখানে।
জম্মু কাশ্মীরের সংবিধান সংশোধনের জন্য ৩৭০ ধারাকে একাধিকবার ব্যবহার করা হয়েছে যদিও ৩৭০ ধারার অন্তর্গত ভাবে রাষ্ট্রপতিরও সে ক্ষমতা নেই। পাঞ্জাবে এক বছরের বেশি রাষ্ট্রপতি শাসন জারি রাখতে সরকারের ৫৯তম, ৬৪ তম, ৬৭ তম এবং ৬৮তম সংবিধান সংশোধনী প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু জম্মুকাশ্মীরের ক্ষেত্রে শুধু ৩৭০ ধারা প্রয়োগ করেই সে কাজ চলে যায়। তালিকাভুক্ত রাজ্যগুলির জন্য আইন প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ২৪৯ নং অনুচ্ছেদ জম্মু কাশ্মীরে লাগু করার জন্য বিধানসভায় কোনও প্রস্তাব পাশ করানো হয়নি, রাজ্যপালের সুপারিশের ভিত্তিতেই তা কার্যকর হয়ে যায়। এসব দিক থেকে দেখলে ৩৭০ ধারা জম্মু কাশ্মীরের অধিকারকে অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় খর্ব করে। এখন ৩৭০ ধারা, জম্মু কাশ্মীরের থেকে ভারত রাষ্ট্রের পক্ষে বেশি সহায়ক।
2019 খ্রিস্টাব্দের 5 আগস্ট ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ জম্মু ও কাশ্মীর 370 ধারা এবং 35A ধারা কে অকার্যকর করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা খর্ব করেন। এবং জম্মু ও কাশ্মীরকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে সেই দুটিকে ভারতের দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
জম্মু কাশ্মীরের সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে যে জম্মু কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

No comments:

Post a Comment